মানুষের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত আছে। ১৮৫৯ সাথে প্রকাশিত "on the Origin of Species" গবেষণাগ্রন্থে ডারউইন জীবজগতের বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। যা সর্বপ্রথম মানুষের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানমনস্তকদের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এর পর একে একে নৃবিজ্ঞান , জীবাশ্মবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, অঙ্গসংস্থানবিদ্যা, জিনতত্ত্ব মানুষের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে। হোম স্যাপিয়েন এর উৎপত্তি বন মানুষের নিকটতম কোন প্রজাতি থেকে। আনুমানিক ২৩ লক্ষ থেকে ২৪ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে হোম গণের যেসব প্রাণির উদ্ভব ঘটেছিলো তাদের মধ্যে শুধুমাত্র মানুষেই টিকে আছে পৃথিবীতে। বিলুপ্ত গুলোর মধ্যে হোমো নিয়ানডার্টালেনসিস, যারা মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে বসবাস করতো। আর এশিয়া জুড়ে ছিলো হোমো ইরেক্টাস প্রজাতিটি। প্রাণির দেহের গঠনের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের নেয়া সার্বাধিক গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটি হলো "আউট অফ আফ্রিকা"। যার সারমর্ম, আনুমানিক ৫০,০০০-১০০,০০০ বছর আগে আফ্রিকাতে উৎপত্তি লাভ করা মানুষ প্রজাতিটি পরবর্তীতে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গেছে।
"মানুষ বিবর্তিত প্রাণি" - বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সমূহঃ
প্রমাণ একঃ
সংরক্ষিত ফসিল-
১। মানুষের কংকালটির পাশে একটি বানরের কংকাল। যা বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যাদুঘর, আগারগাঁও, ঢাকায় সংরক্ষিত আছে। দুইটির মাঝে খুব একট পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।

২। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পায় মানুষের বৃহৎ আকৃতির দেহাবশেষের কিছু চিত্র।

প্রমাণ দুইঃ
রক্তের সিরাম পরীক্ষা-
রক্তে বিদ্যমান হিমোগ্লোবিন রক্তকে জমাট বাঁধায়। রক্ত জমাট বাঁধলে ঈষৎ হলুদ রঙ্গের তরল পদার্থ দেখা যায়, এগুলোকে সিরাম বলে। রক্ত সিরামে এন্টিজেন থাকে, যা অন্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করলে এন্টিবডি তৈরি করে। একজনের শরীরের সিরাম অন্য কারো শরীরে প্রবেশ করালে এন্টিজেন ও এন্টিবডির বিক্রিয়া শুরু হয়। এতে এক প্রকার তলানী কিংবা অধ:ক্ষেপ তৈরি হয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষের সিরাম লেমুন, বানরের শরীরে প্রবেশ করালেও অধ:ক্ষেপ তৈরি হয়। যেসব প্রাণী মানুষে নিকটতম
শ্রেণী, গোত্রের তাদের ক্ষেত্রে তলানীর পরিমাণ বেশি হয়। মানুষের সিরাম বিভিন্ন প্রাণির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেখা গেছে, পুরুষ বানরের ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি তলানী তৈরি হয়। পর্যায়ক্রমে এই তলানীর পরিমান বেশি পুরনো পৃথিবীর বানর, লেমুনের ক্ষেত্রে।
রক্তের সিরাম নিয়ে এসব পরীক্ষা মানুষের বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করে।
প্রমাণ তিনঃ
কোষবংশগতিবিদ্যা-
অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী আছে পৃথিবীতে কিন্তু সবগুলো প্রজাতিই "কমন জিন" বহন কিংবা শেয়ার করে। নিকটতম পূর্বপুরুষদের সাথে এই শেয়ার পরিমাণ বেশি। তাই আধুনিক মানুষ ও শিল্পাঞ্জির DNA প্রায় ৯৬% মিল পাওয়া গেছে। কুকুর আর মানুষের ক্ষেত্রে সেটা ৭৫% আর ড্যাফোডিল ফুলের সাথে ৩৩%।
DNA কি?
মানব দেহ অসংখ্য কোষ নিয়ে গঠিত। প্রতিটি কোষের মাঝে থাকে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে জোড়ায়জোড়ায় ক্রোমসোম থাকে। মানুষেরক্ষেত্রে ২৩ জোড়া ক্রোমসোম বিদ্যমান। বিভিন্ন জীবের ক্ষেত্রে ক্রোমসোম জোড় বিভিন্ন। এই সব ক্রোমসোমের ভিতরেই DNA ও প্রোটিন থাকে। DNA এক প্রকার এসিড যা বিভিন্ন প্রকার প্রোটিন তৈরিতে সহায়তা করে। প্রোটিন শারীরিকবৃত্তিক কাজ সম্পন্ন করে। অন্যদিকে DNA রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়ার প্রতিলিপি সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন DNA তৈরি করে। এভাবে অসংখ্য নতুন DNA প্রতিলিপি তৈরি হয়। এই DNA -ই জীবের বংশ গতির ধারক ও বাহক। যেহেতু পৃথিবীর মানুষের গঠনগত ও আচারণগত ভিন্নতা আছে সেহেতু জীব বিবর্তন ধারা মেনে চলে। আর নতুন ডিএনএ তৈরির অর্থই নতুন জীবনের একক তৈরি।
প্রমাণ চারঃ
অঙ্গসংস্থানবিদ্যাঃ
১। অতিরিক্ত Vertibera - সাধারণভাবে মানুষে পাজরে ১২ টি ট্রিপিক্যাল ভ্যার্টিবেরা থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। মেডিকেল পরীক্ষায় কিছু মানুষের দেখা গেছে ১৩ টি ভ্যার্টিবেরা থাকতে। পৃথিবীর প্রায় ৮% মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে। অন্যদিকে গরিলা ও শিল্পাঞ্জির ১৩ টি ট্রিপিক্যাল ভ্যার্টিবেরা তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য।
২। কোমরের হাড়/Bone pelvis - পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এই হাড়ের গঠনগত পার্থক্য আছে।
* গ্যাইনোকড়েট- যা গোলাকার পেলভিস। ৫০% নারীর ক্ষেত্রে এমনটা থাকে।
*অ্যানড্রয়েট - যা হার্ট স্যাপের হয়ে থাকে।
*অ্যানথ্রপয়েট - যা ওভাল আকৃতির। আফ্রিকান নিগ্র মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়।
*প্লাটিপয়েট - যা ফ্লাট আকৃতির।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলভেদে মানুষের দেহের হাড়ের গঠনের পার্থক্য বিবর্তন ধারাকে সমর্থন করে।
৩। Coccyx হাড় - মানুষের আদি পূর্বপুরুষ প্রাইমেটরা গাছে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য লেজ ব্যবহার করতো। বিবর্তনে মাধ্যমে মাটির ওপরে বসবাসে উপযোগি হয়ে ওঠেছে। কিন্তু ঐ হাড় রয়ে গেছে।
৪। অ্যাপেন্ডিক্স/Appendix - আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেটরা ছিল তৃনভোজি। তৃণজাতীয় খাবারে সেলুলোজ থাকে। এই সেলুলোজ হজম করার জন্য তাদের দেহে এপেনডিক্সে বেশ বড় ছিল। ফলে সিকামে প্রচুর পরিমান ব্যাকটেরিয়ার থাকতে পারতো যাদের মূল কাজ ছিল সেলুলোজ হজমে সহায়তা করা। সময়ের সাথে আমাদের পূর্বপুরুষদের তৃনজাতীয় খাবারের উপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে, তারা মাংসাশী হতে শুরু হলে। আর মাংসাশী প্রাণীদের অ্যাপেন্ডিক্সের কোন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বৃহৎ পাকস্থলীর। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট অ্যাপেন্ডিক্স এবং বড় পাকস্থলীর প্রাণীরা সংগ্রামে টিকে থাকার সামর্থ লাভ করে, হারিয়ে যেতে থাকে বাকিরা। পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেই অ্যাপেন্ডিক্স আমরা এখনও বহন করে।

৫। আক্কেল দাঁত - আমাদের আক্কেল দাঁত নামক এক প্রকার দাঁত আছে। যা বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আমাদের আদি পূর্বপুরুষ প্রাইমেটরা ভৃণভোজি ছিলো আর এই দাঁত ব্যবহার করত। পাথর ও আগুন ব্যবহার শেখার আগে এমনটা ছিলো।

৬। শরীরের লোম- অনেকের ক্ষেত্রে বেশি আবার অনেকের ক্ষেত্রে কম দেখা যায়। আমাদের সমগোত্রীয় বিলুপ্ত কিংবা অবিলুপ্ত প্রাণিগুলো লোমশ ছিলো। যেমন, বানর, লেমুন গরিলা।
মানব মস্তিস্কের বিবর্তন
মস্তিস্কের ওপরে মানুষের বিবর্তনের মূল প্রভাব পড়েছে। মানুষের একই শ্রেণী, গোত্রের অনেক প্রাণিই প্রকৃতিতে টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ টিকে আছে শুধুমাত্র তার মস্তিস্কের জোরেই। যদিও মূল শরীরের ২% মস্তিস্ক কিন্তু পুরো শরীরের তুলনায় ২০% শক্তি খরচ হয় মস্তিস্কে। মস্তিস্কের বাইরের দিকের অংশ নিওকর্টেক্স। এটি চিন্তা, কল্পনা, অনুভূতির বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের বিবর্তনে সব থেকে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে নিওকর্টেক্সের।
তথ্যসূত্রঃ
*ইউকিপিডিয়া
*বিবর্তনের পথ ধরে- বন্যা আহমেদ